ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান, বিপ্লব, নারী
Matrix Trilogy
নাম: মোঃ খায়রুল বাশার বাঁধন
…..
২০০১ সালের কথা। ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা শেষে ডিসেম্বরের শেষ কটা দিন বিনোদন পেতে আব্বু একটা ডিভিডি প্লেয়ার ভাড়া করে এনেছিলো। আর সাথে একগাদা সিডি। সবুজ কভারের উপর কালো-সাদা ছাপে তখনই ম্যাট্রিক্সের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম কিস্তি মুক্তি পেয়েছিলো মাত্রই তখন। ১৪ ইঞ্চি সাদা-কালো টিভিতে ঝাঁ ঝাঁ চকচকে ধুমধারাক্কা একশান মুভি হিসাবেই পরিচয় হয় নিও, ট্রিনিটি, মরবিয়াস, নাইরোবির সাথে। সে সময় আর পরের ২ কিস্তি দেখার সুযোগ হয় নি। কিন্তু মগজে দৃশ্যগুলো রয়ে গিয়েছিলো। এর প্রায় বছর ৭ পর নিজের উদ্যোগেই ৩টা সিনেমা একসাথে দেখি রঙিন স্ক্রিনে। ইংরেজি কমসম বুঝলেও প্রথম আলোর বিনোদন পাতায় বিশাল এক নিবন্ধ পড়ে নিয়েছিলাম এই সিনেমা সম্পর্কে। ফলে একবিংশ শতাব্দীর মুভি ইন্ডাস্ট্রির মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এই মাইলফলকটি যেভাবেই হোক অল্প অল্প করে আমার ছোট্ট মগজে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। এরপর একসময় নিজের ল্যাপটপ হল; ‘Subscene’ নামক এক জাদুর বাক্সে সাইমন এলেক্স, মসিউর শুভ্র নামক জাদুকরেরা চোখের সামনে ভিন্ন এক অর্থ ধরিয়ে দিল ম্যাট্রিক্সের।
.
যাই হোক, সর্বশেষ কিস্তি মুক্তি পাবার ১৮ বছর পর মুক্তি পেল Matrix এর ৪র্থ কিস্তি Matrix Resurrection. যদি নষ্টালজিক মূল্য ধরি তবে মুভির মান হিসেবে কিছুটা সম্মান পেতে পারে নতুন সিনেমাটা। নতুন করে ট্রিলজি শুরুর ব্যাপারটা অনেকের কাছে Money Grabbing অপরচুনিটি মনে হচ্ছে বটে; কিন্ত আমি ভাবছি এটা জাস্ট Meta into Metaverse Matrix. যদি আপনারা আগের নির্মিত ৩টা সিনেমার মূল ফিলোশফিটা প্রপারলি আত্মস্থ করতে পারেন তাহলে আপাতদৃষ্টিতে অতি Poor Execution এ Matrix Resurrection মুভি থেকেও আপনারা বেটার কিছু আশা করতে পারবেন ভবিষ্যতে।
Matrix Resurrection মুভির মূল সুর বুঝতে হলে আপনাকে ম্যাট্রিক্সের দুনিয়াটা বুঝতে হবে। এবং এই প্রজন্মের কাছে যেটা দুঃসহ যন্ত্রণা সেই পড়াশোনা থাকতে হবে। একটা ট্রিভিয়া দেই- গত শতাব্দীতে নির্মিত যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বা সাইন্স ফিকশান নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে অদূর ভবিষ্যতে সত্য হয়েছে বা হতে যাচ্ছে এমন মোস্ট একুরেট তাত্ত্বিক মুভির মধ্যে Matrix এর কন্সেপ্ট ৩য় অবস্থানে। বাকি দুটো হল ‘টার্মিনেটর’ ও ‘২০০১ এ স্পেস ওডিসি’। তবে মাথা খারাপ করা বৈজ্ঞানিক কনসেপ্ট, চোখ জুড়ানো ভিজুয়াল গ্রাফিক্সের বাইরে ম্যাট্রিক্সের অমরত্বের মূল কারণ ছল এর দর্শন, ভিশন, সিম্বলিস্টিক ইনার ম্যাসেজ। চলুন, খুবই সংক্ষিপ্ত ও সোজাসাপ্টা ভাবে কয়েকটা লেয়ার সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করিঃ
.
১) ধর্মঃ ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের বেসিক কিছু ব্যাপারের সাথে সরাসরি যুক্ত Matrix মুভি। সৃষ্টির শুরুতে আরশে আজিমের নিচে মানুষ ও ফেরেশতার সমন্বয়ে বেহেশতে বেশ চমৎকার সুশৃঙ্খল জীবন ছিল। ইতোমধ্যেই আল্লাহর আদেশ মেনে সেজদাহ করতে না চাওয়ায় আজাজীল বা ইবলিশ বেহেসতে থেকে বিতাড়িত হয়েছে। সেই ইবলিশ শয়তান নানা কূট কৌশলে বেহেশতে প্রবেশ করে। প্রথমে বিবি হাওয়া এবং তাঁর মাধ্যমে আদি পিতা আদমকে গন্ধম ফল (Red Pill) খাইয়ে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় প্রথম পুরুষ (The One) হিসেবে আগমন ঘটায়। এবং যার ফলে আমাদের সবাইকেও বেহেশত থেকে মায়ের পেট হয়ে দুনিয়ায় আসতে হয়। মায়ের পেটে আমরা থাকি কিভাবে?
লিকুইড একটা উপাদানের ভেতরে ডুবন্ত অবস্থায় মায়ের গর্ভে (Pod) আমাদের নাভিতে নাড়ির সংযোগের মাধ্যমে বেঁচে থাকি আমরা জন্মের আগ পর্যন্ত। এবং মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে সবার আগে আমাদের এই নাড়ি কাটা হয়।
.
এবার প্রিয় পাঠক, Matrix এর গল্পের সাথে উপরোক্ত ধর্মীয় ব্যাপারটা মিলিয়ে দেখুন। কম্পিউটার জেনারেটেড একটা মায়ার জগতে একদল মানুষ Blue Pill নিয়ে আরাম আয়েশেই থাকে। একদিন সেই জগতের ভিতরে বাইরের কিছু অনুপ্রবেশকারি প্রবেশ করে। এরমধ্যে Trinity নামক এক নারী Neo কে নিয়ে মরবিয়াসের কাছে যায়। মরবিয়াস তাকে কথার প্যাঁচে ফেলে রেড পিল খাওয়ায়। এবং ‘নিও’ জেগে ওঠে এক বার্থ পডে নানা রকম নল শরীরে লাগানো অবস্থায়। সেই নল/পাইপ মুক্ত হয়েই রিয়েল ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করে তারা।
....
২) বিপ্লবঃ Matrix এর গল্পকে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের কাহিনীও বলতে পারে। অত্যাচারি রাজা যে কিনা তার রাজ্যের বৈজ্ঞানিক কোডিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে বোকা বানিয়ে তাদের থেকে চুষে খাচ্ছে সবকিছু। একদিন বাইরের কেউ চুপিসারে সেই রাজ্যে প্রবেশ করে। একটা দুটো করে মানুষকে রাজার তৈরী বৈজ্ঞানিক যন্ত্রর-মন্তর কোডিং থেকে বের করে আনে। এবং শুরু করে রাজার বিরুদ্ধে প্রজার বিপ্লব। সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ কিংবা কদিন আগে জেমস গানের ‘দ্য সুইসাইড স্কোয়াড’ কিংবা আমাদের আলোচ্য ম্যাট্রিক্স সবই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সাধারনের মাঝে অনন্য সাধারণ কোন এক ‘দ্য ওয়ানে’র হাত ধরে মানুষের মুক্তির গল্প। লেনিন, চে, ক্যাস্ত্রো এরা একেকজন একেক ম্যাট্রিক্সের ‘দ্য ওয়ান’ তাই নয় কি?
....
৩) নারীবাদঃ সে অনেক কাল আগের কথা। সমাজ-সংসার-পরিবেশ-ধর্ম নারীর জন্য একটা জ্যামিতিক সীমানা নির্ধারন করে রেখেছিলো। যত যাই কিছু হয়ে যাক সেই সাংসারিক লক্ষণ-রেখা পার করার সাহস-শক্তি কোনটাই নারীর ছিল না। বেগম রোকেয়ার লেখায় ‘অসূর্যস্পর্শা’। অর্থাৎ সূর্যের আলোও নারীকে যেন স্পর্শ না করে। স্বামী, সন্তান, সংসার তা যেমনই হোক তা ছাড়ার অধিকার নারীর ছিল না- বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ স্বামী যে কিনা বছর জুড়ে শ্বশুরবাড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়; কোনদিন ২ রাতের বেশি বছরে স্বামীসঙ্গ পায় নি যে বউ; তাকেও সতীর চিতায় সহমরণে যেতে হত। যে স্বামী ইহজগতে কোনদিন দায়িত্ববোধ পালন করেনি, মৃত্যুশয্যায় সে স্বামীর চরণধূলা না পেলেও স্ত্রীর নাকি স্বর্গযাত্রা হত না। সেই সমাজে একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে একজন লিখলেন ছোটগল্প ‘স্ত্রীর পত্র’। পুরো বাঙ্গালী সমাজে রি রি পড়ে গেল। ঠাকুর বাড়ির ছট ছেলে এ কী লিখেছে। বাঙ্গালী ঘরের বউ কিভাবে তার স্বামী-সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে? বধূ সেজে যে ঘরে একবার ঢুকেছে মৃত্যুর আগে কি করে সেই মায়া ছেড়ে বের হতে পারে কোন মেয়ে? যে মেয়ে এভাবে ঘর ছাড়ে সে আসলে কুলটা, সতীহীনা, দুঃশ্চরিত্র।
যারা Matrix Resurrection দেখেছেন ইতোমধ্যেই, ট্রিনিটি’র সাথে এই অংশে মিল খুঁজে পাচ্ছেন কি? কিংবা ম্যাট্রিক্সের কন্সপ্টের সাথে নারীর যাতনা সংগ্রামের মিল পাচ্ছেন কি?
...
৪) ডিজিটাল জগতঃ এই ২০২১ সালে এসে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি আমাদের যেভাবে গ্রাস করে ফেলেছে এই জীবনে বাস্তব জীবনটা কখনো কখনো বড্ড নকল মনে হয়। মুভি, সিরিজ, গেম, ভিডিও, সোশাল মিডিয়া প্রভৃতির চাপে আমাদের জীবন স্পষ্টতই ২ ভাগে বিভক্ত। অনলাইনে হাজারো বন্ধু, বাস্তবে ২ জনও নেই। কী বোর্ডের ট্যাপে হাজারজনকে গালমন্দ করতে পারি; কিন্তু সামনাসামনি ৪টা কথা কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারিনা। এই অন্তর্মুখী নার্সিসিস্ট জীবনে যখন আমাদের চেয়ে আলাদা কেউ আমাদের এই জগত থেকে বে করতে চায়; স্বভাবতই সে আমাদের চোখে Not Cool Bro হয়ে যায়। যেহেতু বাহিরের বাস্তবতাটা অনেক বেশি রূঢ় তাই আমরা আমাদের কম্ফোর্টের বাইরে যেতেই চাই না। Matrix Resurrection তার স্বল্প সময়ে মূলত আমাদের এই জীবনটাকে খোঁচানোর চেষ্টা করেছে Warner Bro Company’র নামে।
.....
আরো অনেক রকম দিক আছে ম্যাট্রিক্সের। পুঁজিবাদ, অর্থনীতি, সাম্যবাদ, এক্সট্রোভার্ট, ইন্ট্রোভার্ট, টেকি, নন টেকি, এ যুগের কিংবা সে যুগের যেই হোননা কেন ম্যাট্রিক্স কোন না কোনভাবে আপনাকে তার সাথে যুক্ত করে নেবে। প্রয়োজন শুধু ‘রিয়েলিজম’ টা দেখার জন্য প্রচুর ধৈর্য এবং সঠিক দরজায় চোখ রাখা।
আপনার আছে তো সেই ধৈর্য?
Then Welcome to The Matrix
1 Comments
পড়ে কেমন লাগলো জানাবেন
ReplyDelete