যারা রয়ে যায় চোখের আড়ালে

 যারা রয়ে যায়

চোখের আড়ালে

- কাকলি চক্রবর্তী



ব্যস্ত শহরে কিছু মুখ,

কিছু অবয়ব ছায়া ছায়া,

তারা থাকে দূরে দূরে,

তারা যেন ছাড়া ছাড়া।

পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম

একেবারে পাশটিতে,

সবাই আমায় দেখছে,

হয়তো ভাবছে,

কী দুঃসাহস আমার এই মনটিতে।

সবাই যে তাদের এড়িয়ে চলে,

চলে দূরে দূরে,

কেউ যদি সাহায্যের ছলে আসেও

তাদের কাছে,

তারা সরে যায় বহু দূরে।

এনারা এই মহানগরের বাতিলের পর্যায় পরে।

এই শহর তাদের আপন করলেও

আপন করেনা মানুষ।

এই সব মানুষ দের শহরে পরে থাকা আবর্জনা

বলেই মনে করা হয়।


মানুষ টি এক মনে কী যেন লিখে চলেছে।

কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বুঝলাম,

না, লেখা নয়,

উনি এক মনে ছবি আঁকছেন।

কিছু কাঠ কয়লা, ভাঙা ইটের টুকরো,

চুনের গুঁড়ো,

আরো নাম না জানা কিছু জিনিস দিয়ে

উনি ছবি  আঁকছেন  মন প্রাণ দিয়ে।

একের পর এক ছবি বিরাট দেওয়াল জুড়ে

ফুটে উঠছে।

কখনো প্রকৃতি, কখনো এক মা ও শিশু,

ভগ্ন শহরের নানান দৃশ্য,

কখনো যুদ্ধের ছবি,

রাজ রাজাদের ছবি,

জীব জন্তু, পাখির ছবি,

এমনি সব উপাদানে ভরপুর তার ছবি।

ছবির সঙ্গে আছে কিছু কথাও।

কিন্তু সেই লেখা পড়ার উপায় নেই।

পড়তে না পারলেও বুঝলাম,

ঐ ভাষা,

যা উনি ছবিগুলির সাথে লিখেছেন,

সবই বিদেশী ভাষা। বিভিন্ন বিদেশী ভাষার সাথে

কিছু ইংরেজি ভাষার মিশ্রনে

ছবি এবং লেখা একে একে ফুটে উঠছে

ফুটপাথের দেওয়ালে।

মাঝ বয়সি মানুষ,

পরনে ছেঁড়া ফাটা পোশাক,

মাথায় এক রাশ কাঁচা পাকা চুল

ঘাড় অবধি নেমেছে।

শীর্ণ দড়ি পাকানো চেহারা,

খানিক ঝুঁকে পরেছে সামনের দিকে।

ধুলো মলিন পায়ে ছেঁড়া চপ্পল।

সেই জীর্ণ অবক্ষয়ের শীর্ণ দীর্ঘ আঙুল  গুলি

কিন্তু সজীব,

আবেগে ভরপুর।

তার আঙুলের অবিরাম ওঠা পরায় একে একে

পরতে পরতে সৃষ্টি হয়ে চলেছে,

কী ভীষণ সুন্দর কারু কার্য।

সত্যি কত দামি।

দামি?

সত্যি কী তাই?

কিন্তু কেই বা তার বিচার করবে?

এই মানুষ টি যে কত বড়ো  শিল্পী,

গুণী ব্যক্তিত্ব,

কেই বা তার মূল্যায়ন করে?


কোনো দিকে তার দৃষ্টি নেই,

নেই লক্ষ।

তার মন জুড়ে শুধুই একের পর এক সৃষ্টি।

কিছু নূতন কিছু পুরাতনে

মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়

তার সৃষ্টির উন্মোচন।


আমাকে দেখে কিছু উৎসাহী মানুষ এগিয়ে এসে

সেই গুণী মানুষটির ছবি তুলতে শুরু

করলেন।

এবার বিরক্ত হলেন মানুষ টা,

একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন সবার দিকে।

তার উজ্জ্বল দুটি চোখে মায়া আর ঘৃণার মিল মিশ।

আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে,

সে তার যা কিছু কাজের জিনিস পত্র গুছিয়ে

হাঁটা দিল তার গন্তব্যের পথে।

মুহূর্তে হারিয়ে গেলেন সবার চোখের আড়ালে।


খানিক পরেই হয়তো কিছু মানুষ এসে তার সব সৃষ্টি

একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে।

হয়তো দেওয়াল নোংড়া করার অপরাধে তার

শাস্তিও হতে পারে।

হয়তো চড়, থাপ্পড়, লাথি টুকুও

পাওনা হবে তার।

সাফ সুতরো রাখতে হবে শহর,

শহরকে ধুলো দূষণ মুক্ত রাখতে তারা বদ্ধ পরিকর।

এই ছায়া ছায়া মানুষগুলি এই শহরে বার্ত্য,

তাদের কীট পতঙ্গ জ্ঞানে পায়ে মাড়িয়ে পিষে দূর

করতে চায় শহর,

আর শহরের মানুষ জন।

এই মহানগর সুন্দর হোক,

সুস্থ থাক।

সেই কামনায় এরাও বেদুইন চলে,

শহর থেকে শহরে।

দূর থেকে বহু দূরে।

একে একে পাড় করে যায়

সব কটি সভ্যতার মাইলস্টোন।

আমি প্রার্থনা করি,

তোমরাও থাকো ভালো,

এমনি থাকো একমনে।

এই শহর তোমাদের ও,

তোমাদের নিজেদের।

Post a Comment

0 Comments