"ধর্ম বনাম আধ্যাত্মিকতা"

একটি সাম্প্রতিক সময়ের দ্বন্দ্বগত পার্থক্য।

- মিথুন বড়ুয়া 



সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ম নিয়ে অনেক উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি একে একে বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, ইসলামধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম, ইহুদিধর্ম ইত্যাদি এগুলোর একটা উত্থান ঘটছে, কিন্তু সমস্যা হলো ধর্ম অনেক পবিত্রতা, শান্তির কথা বললেও বাস্তবে আমরা এর-ফলাফলে উল্টোটাই দেখতে পাই, আমরা দেখতে পাই নানা ধর্মের মাঝে সংঘর্ষ, শান্তির বদলে অশান্তি। 


কিন্তু এসব আসলে কেন?


এটা এই কারণে যে, ধর্ম সম্পর্কে আমরা জানি'না, আমাদের কোন স্পষ্ট ধারণা নেই, কেবলমাত্র কতগুলো গ্রন্থের বিশ্বাস'ই আমাদের তথাকথিত ধর্ম, আমরা ধর্মের যে রূপ সে রূপে কেবল অন্ধবিশ্বাস তথা ডগমাই দেখতে পাই, যেখানে ধর্মের মূল কথা ছিলো ধারণ করা, ধর্ম শব্দ'টি এসেছে প্রাচীন ল্যাটিন শব্দ Religare থেকে যার ইংরেজী'তে অর্থ করলে দাঁড়ায় "To Bind" তথা একত্রিত করা বা সংযুক্ত করা।


ধর্মের ইতিহাস বেশ প্রাচীন, অনেক কাল থেকেই ধর্ম চলে আসছে যা আজও তাঁর প্রবাহ রয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ'রা ধর্ম বলতে যা বুঝে থাকে তা আসলে কী?


এর-উত্তর দিতে গিয়ে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ'রা ধর্মের মূলস্রোতে গিয়ে এর-একটা সামন্ঞ্জস্যপূর্ণ অর্থ দিতে পারেন, কিন্তু কথা হলো ধর্মের ব্যাপারে এ-সংস্কারগত অর্থের সাম্প্রতিক সময়ে কোন ভিত্তি নেই বলেই আমার মনে হয়।

অন্ততপক্ষে কোন কোন ব্যক্তির পক্ষে সে যদি এটার প্রকৃতঅর্থ অনুধাবন করে এটাকে এ-নামে বুঝে নিয়ে স্বস্তি পেতেও চায় তা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়, তবে সামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ মানুষ ধর্ম বলতে সেই প্রাচীনকালের মহামানবেরা যার গোড়াপত্তন করে গেছেন সে অর্থে বুঝে থাকেন। তারা এটাকে অন্ধভাবেই বিশ্বাস করে বসে থাকে কোনপ্রকার নিজের বোধগত অভিজ্ঞতা লাভ ছাড়াই, তাই ধর্ম আর কিছুই নয় একটা ডগমাতে পরিণত হয়ে গেছে সাম্প্রতিক সময়ে।

এরমধ্যে কেউ কেউ আবার ধর্মের সাথে এর-গুহ্য উপাদানগুলো'কে মিশিয়ে এক করে দেখে এটাকে ধর্ম বলে ধরে নেন, এরফলে তাঁদের ধরে নেবার দ্বারা মোটাদাগে সমাজের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের অন্ধবিশ্বাসের স্বপক্ষে একটা আধ্যাত্মিক ভ্যালু লাভ করে, যদিও আমরা সমাজের মেইনস্ট্রিমে যে ধর্মের অর্থ দেখি তা এসব গুহ্যতত্ত্ব'কে আমলে নেয়'না।


তাই ভাবলাম যে, ধর্ম (Religion) ও আধ্যাত্মতা (Spirituality/Mysticism) এ-দুটির মাঝে যে পার্থক্য সাম্প্রতিক সময়ে তৈরী হয়েছে তাঁর একটা ধারণা এই আর্টিকেলে আপনাদেরকে শেয়ার করি, তাহলে চলুন জেনে নেই ধর্ম ও আধ্যাত্মতার কিছু বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যঃ


১. ধর্ম হলো কোনকিছুকে কোন বিচার বিবেচনা ছাড়াই আগে থেকেই বিশ্বাস করা।

অন্যদিকে- একজন ব্যক্তির আধ্যাত্মতার পথে যাত্রা শুরু হয় ধর্মীয় বিশ্বাস'কে প্রশ্ন করার মাধ্যমে। 


২. ধর্ম'তে সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী-ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট  নিয়ম-কানুন, আচার-আচরণের কঠোর বিধি রয়েছে। 

অপরদিকে- আধ্যাত্মতায় কোন সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা একক কোন ধর্ম নেই, এতে সকল ধর্মের গুহ্য ও মরমীয় বিষয়ের সারৎসার অন্তর্ভুক্ত।

কোন ব্যক্তির তাই আধ্যাত্মতা পালন করতে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হতে হয়'না, তবে সে চাইলে অনুসন্ধানের দ্বারা তাঁর ব্যক্তিগত পারসেনালিটি অনুযায়ী বিধি অনুযায়ী সাধনা করতে পারে যা কোন গ্রন্থ দ্বারা আরোপিত নয় বরং, নিজের ইচ্ছা দ্বারা সমর্থিত।


৩. ধর্মে একজন গডহেড থাকে ও তাকে মেনে নিয়ে সুনির্দিষ্ট রিচুয়াল পালন করা হয়। 

কিন্তু আধ্যাত্ম তথা স্পিরিচুয়ালিটি'তে গডহেড থাকে'না বরং এ-উপলব্ধি থাকে যে, নিজের মাঝে গডের বিকাশ হওয়া সম্ভব।


৪. ধর্মীয় রিচুয়াল'গুলো যারা পালন করেন তারা এর-অন্তর্নিহিত বিষয় সম্বন্ধে অজ্ঞাত।

অন্যদিকে- আধ্যাত্মতায় ব্যক্তি এর-অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে তাঁর আপন জাগরণ দ্বারা তা বুঝতে পারে বা রেকগনাইজ করতে সমর্থ হয়। 


৫. ধর্ম তাঁর বাহ্যিক দিক তথা ধর্মীয় বিধান দিকনির্ভর।

কিন্তু আধ্যাত্মতায় অন্তর্নিহিত দিক তথা ধ্যান সাধনার দিকগুলো বেশী প্রাধান্য পায়, যা হলো সকল ধর্মের মূলভিত্তি, প্রতিটি মহামানবরাই প্রথমে তাঁহাদের রিয়ালাইজেশন ঘটেছে এরপর তাঁহারা মানবজাতির জন্য বাহ্যিক ক্রিয়াকান্ডের অবতারণা করেছেন।


উদাহারণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারেঃ তথাগত বুদ্ধ ৬বছর কঠোর সাধনা বোধিবৃক্ষমূলে বুদ্ধত্বলাভ করেন এবং প্রথমে পঞ্চবর্গীয় শিষ্য'দের ধর্মপ্রচার করেন এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন এবং পরে জনসাধারণের মাঝে সেই জ্ঞান বা ধর্ম প্রচার করেন।

ইসলামধর্মের নবী মুহাম্মদ হেরা গুহায় ১৫ বছর ধ্যানমগ্ন ছিলেন, তারপর তিনি বিশ্বাস নিয়ে কথা বলেছেন।

আর এ-ধ্যানমগ্নতা হলো আধ্যাত্মের গুপ্তদিক যা ধর্ম থেকে বরাবরই উপেক্ষিত।

এছাড়াও খ্রিস্টধর্মের যিশুর ১৩-৩০ বছর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ তথা অনুসন্ধান ও শিক্ষার পর তিনি ভালোবাসা ও ঈশ্বরের কথা বলেন তার আগে নয়।

মূসার তুর পাহাড়ে গমন, ইব্রাহীমের আকাশের তারার দিকে চেয়ে অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদি এ সবের ফলাফল ছিলো ধর্মীয় বাহ্যিক কাঠামো, কিন্তু ক্রমান্বয়ে এগুলো নানা মিথ্যার দ্বারা অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা কলুষিত হয়ে গেছে, আধ্যাত্মতা হলো এ-কলুষতা, অন্ধবিশ্বাস থেকে সকল ধর্মের সারৎসার তথা গুহ্য অন্তর্দৃষ্টির প্রতি জাগরণ ও এ-ব্যাপারে মুক্ত অনুসন্ধানের স্পৃহা।


৬. ধর্ম'তে যা বলা হয়েছে তাতে বর্ণিত ঘটনাগুলোর সরাসরি মিনিং ধরে নিয়ে মানুষ'রা ভুল করে থাকে।

অন্যদিকে- আধ্যাত্মতায় এ-বোধ জাগরিত হয় যে, ধর্মগ্রন্থ'গুলো'তে যা বলা হয়েছে তা রূপক আকারে বলা হয়েছে ও এর-পেছনে গভীর তাৎপর্য রয়েছে যা কেবল মেনে না নিয়ে নিজের অন্তর্দৃষ্টির কষ্টিপাথরে বিবেচনা করে নিতে হয়৷ 


৭. ধর্ম'তে যারা বিশ্বাস করেন তারা মূলত তাঁদের গোষ্ঠীভিত্তিক একক ধর্মে বিশ্বাস করেন ও নিজের ধর্মের প্রতি অতিমাত্রায় টান থাকার ফলে এটা বদ্ধতার সৃষ্টি করে। 

অন্যদিকে যারা আধ্যত্মচর্চা করেন তারা একক কোন ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকেন'না।

তাঁদের কাছে সকল ধর্মের গুহ্য বিষয়াবলিই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়, তাঁর ধর্ম মানার নয় বরং যাপনের বিষয় হয়ে ওঠে, আধ্যাত্মে সকল ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা থাকার ফলে এটি ব্যক্তিকে আবদ্ধ করে'না বরং মুক্ত করে।


৮. ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক; আধ্যাত্মতা প্রাতিষ্ঠানিক নয়।


৯. জন্মগতভাবেই কোন ব্যক্তি ধর্মের মাধ্যমে ইনডক্ট্রিনেট হয়। 

কিন্তু আধ্যাত্মতায় ইনডক্ট্রিনেশন নেই, বরং ইনডক্ট্রিনেশন ভেঙ্গে এটি নিজের পথ গড়ে নেয়।

১০. বৌদ্ধের ঘরে জন্মালে বৌদ্ধ, হিন্দু ঘরে জন্মালে হিন্দু, মুসলমান ঘরে জন্মালে মুসলমান, খ্রিস্টানের ঘরে জন্মালে খ্রিষ্টান আর ইহুদীর ঘরে জন্মালে ইহুদী,  এভাবে যে ঘরে জন্মায় ব্যক্তি সে ধর্মের বলে তাকে চিহ্নিত করা হয়। 

কিন্তু জন্ম থেকেই কেউ আধ্যাত্মিক হয়ে যায়'না... অনুসন্ধান, উপলব্ধি, সাধনা, বোধ ইত্যাদি এসব দিয়ে ব্যক্তি'কে তা ধারণ করে নিতে হয়। 


১১. ধর্ম হলো স্থূল বিষয়; আধ্যাত্ম হলো সূক্ষ্ম বিষয়।


১২. ধর্ম হলো গোষ্ঠীকেন্দ্রীক প্রধান, অপরদিকে আধ্যাত্মে ব্যক্তিগতকেন্দ্রীকতা প্রধান। 


১৩. ধর্ম'তে নাস্তিকতা'কে অগ্রাহ্য করা হয়।

অপরদিকে একজন নাস্তিকের মাঝেও আধ্যাত্মতা পরিলক্ষিত হতে পারে।

যেমনঃ তথাগত বুদ্ধ...

তবে তবে বুদ্ধ নাস্তিকতা'কেও আদর্শ হিসেবে মেনে রক্ষণশীলতায় পর্যবসিত হননি, তাঁহার কোন মতাদর্শ মানার চেয়ে অনুশীলনের মাধ্যমে সরাসরি অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির ওপর জোর দিয়েছেন বেশী। 


এরকম আরও নানারকম বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য তুলে ধরা যায়, নিজের ধর্মের মাঝে আধ্যাত্মতা টের পেলেও এটা কেবল ঐ একক ধর্মের মাঝে নয়, এই আধ্যাত্মতা অন্য সকল ধর্মেও ছিলো, তাই যেজন আধ্যাত্ম পথে বিচরণ করে তাঁহার কাছে সমাজে প্রচলিত একক ধর্মের কোন মানে থাকে'না, এবং এ-দিয়ে সে ব্যক্তি তাঁর ধর্ম'কে জাস্টিফাইও করে'না, আধ্যাত্মের ধারা সবকালে সকল দেশ, মানুষের জন্য উন্মুক্ত, এখানে কোন সীমা নেই, অন্যদিকে ধর্মে নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে, যে সীমানায় কেবল নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর লোকেরাই বিচরণ করতে পারে।


ধর্মের সংজ্ঞা এখন যত গভীরই হউক না কেন, বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তাঁর যথার্থতা নজরে আসে'না, তাই এটি অন্ধবিশ্বাস'ই বলা যায়, তবে কেউ যদি গভীর অর্থে ধর্ম'কে টানতে চান তাহলে প্রথমে তাকে প্রশ্ন, অনুসন্ধান ও তা থেকে তিনি যদি উপলব্ধি'তে আসেন তাহলে সেটাকে তিনি গভীর অর্থে কোন নির্দিষ্ট ধর্মে-

যেমনঃ প্রকৃত সনাতন হিন্দুধর্ম, প্রকৃত বৌদ্ধধর্ম, প্রকৃত ইসলামধর্ম, প্রকৃত খ্রিস্টানধর্ম, প্রকৃত ইহুদীধর্ম- এসবে না টেনে বিভ্রান্ত না হয়ে তাকে আধ্যাত্ম দৃষ্টিভঙ্গি'তে দেখলে ব্যাপার'টার জটিলতা দূর হয়।


এই ছিলো ধর্ম ও আধ্যাত্মতা নিয়ে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও এদের মধ্যাকার পার্থক্য।

অবশ্য আধ্যাত্মিকতারও নানা ডাইমেনশন, সমস্যা, ডিল্যুশন আছে, যদিও এগুলো বেশ সূক্ষ্ম, প্যাঁচালো ও ধোঁয়াটে, এসব নিয়ে ভবিষ্যতে আরও অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা রইলো, আপাতত এ-আশাবাদ ব্যক্ত করে এখনকার মত লেখা'টি সমাপ্ত করলাম।