কল্পজুতোর গল্প
।।সুমন বিশ্বাস।।
একবার গল্পদাদুর কাছে গিয়ে বলি, 'মাছের তেলে মাছ ভাজা' বাক্যটি মানুষের ক্ষেত্রে বলা হয় কেন, দাদু? বলেন, ও পরে শুনিস। এলি যখন বোস। একটা গল্প শোন।
: বলো।
এক দেশে নির্বাচন হবে। সেখানে বহুদল জোট করে শেষে দুটিতে বিভক্ত হয়। তারপর জনগণ টানতে দুদলই ইশতেহার প্রকাশ করে। একদল একজায়গায় লেখে, আমরা ক্ষমতায় গেলে ধর্ম হবে শতভাগ ব্যক্তিগত। ব্যক্তির বাইরে এর প্রভাব, পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে না। তবে পরিবেশ দূষণ, অর্থ আয়ের মাধ্যম না করে এবং অপরের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে যে কেউ নিজ বিশ্বাস/ধর্ম স্বাধীনভাবে লালন-পালন করতে পারবে।
দ্বিতীয় দলটি লেখে, আমরা ক্ষমতায় গেলে ধর্মকে সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্রের সবখানে দৃঢ় করা হবে। এর বাইরে কোনো আইন হবে না। ধর্ম কটুক্তি ও অবমাননাকারীর একমাত্র শাস্তি হবে জুতোর মালা গলায় পরিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর।
বলে রাখা ভালো, গল্পের দেশে সবক্ষেত্রে তখন ধর্মের সীমা ছাড়া প্রভাব পড়েছিলো। উদাহরণে বলা যায়, সিনেমার 'লায়ক-লায়িকারা' চামড়া কুচকানো বা সুবিধা করতে না পেরে নিজেকে ধর্মে লুকিয়ে, যাদের সর্বদা ঘৃণা করতো; এমন সব দেশে স্থায়ী হতো নতুবা ব্যবসায় ঢুকতো। ধর্ম হতো ঢাল। এজন্য অতীতে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করানো জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি ভেঙে পড়ে। খেলাধুলা বেঁচে থাকলেও নারী ছিলো অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। তবে পুরুষের ছিলো লোক দেখানো ধর্ম পালনের রমরমা কাণ্ড কারখানা। খেলায় সাফল্য/জিতলে বোঝা যেত (যে খেলা আবার ধর্মে নিষিদ্ধ)। জেলখানায় উপচে পড়া ভিড়, নতুন উকিলের টেবিলেই কেসের ফাইলে তাকে দেখা যেতো না অবস্থা! এমন কোন মন্দকাজ নেই যা নিয়মিত হতো না। মদ্দাকথায় বিভৎস ভঙ্গির শেষ ছিলো না। মুখে মুখে ধর্ম আর কাজে তার বিপরীত।
যাইহোক, ভোটে দ্বিতীয় দল জেতে। প্রথম দলের সিংহভাগ প্রার্থীর জামানতই বাতিল হয়। প্রথম দলটি ধর্মের বিরোধী ছিলো না; ছিলো ভণ্ডামির বিরোধী। এজন্যই অমন বিষয় ইশতেহারে তুলেছিলো।
এরপর দ্বিতীয়দল ক্ষমতার তিনমাসেই ইশতেহারে বলা কথা শতভাগ দাঁড় ও প্রয়োগ করা শুরু করে। দেশের সিংহভাগ জনতার আনন্দের আর সীমা রইলো না। প্রথমেই স্ব-ঘোষিত নাস্তিকদের ভেতর যারা আইন করার পরও কথা বলতো ধর্মের বিপরীতে, তাদের ধরলো। দেশের লোকের খুশি আর ধরে না। অপরের অপমানে সবচেয়ে বেশি সুখি হতো তারা।
ছয়মাস পরে দেশবাসী জানতে পারে, সুদে কোনো প্রতিষ্ঠান দেশে আর নাই। এজন্য বিদেশি সুদে ঋণ থেকে সুদমিশ্রিত সব বন্ধ। বৃহৎ একাংশ বেকার হয়ে পড়ে, অভাবে দিন কাটাতে থাকে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ভেঙে পড়ে। জনগণের টাকায় কোনোমতে চলতে থাকে দেশ। আনন্দ প্রবল ভাটার টানের মতো কমার দিকে ধাবিত হয়।
একবছর পর দেখে, ধর্ম প্রচার, প্রসারে যারা অর্থ নিতো ও দিতো তাদের বহুজন কারাগারে। ধরাকার্য চলমান। সিংহভাগের ফাঁসি নিশ্চিত হয়। আরও মজা তখন এলো, যখন জানলো, পুলিশ কাউকে ধরলে, উক্ত অপরাধ ধর্মের বিপরীতে গেলেই দুটি কেইস ফাইল হতো।
: কেন?
কারণ, ধর কেউ চুরি করে ধরা পড়েছে। চুরি তো ধর্মের বিপরীত। মানেই ধর্ম অবমাননা! ব্যাস সাজা জুতোর মালা পরিয়ে মৃত্যুদণ্ড!
বছর ঘুরতেই আনন্দ সব পাদের মতো বের হতে লাগলো। তাতে যেমন দুর্গন্ধ, তেমনি পেট ফাঁপানো। ক্ষুধা, দারিদ্রতা বাড়ে জ্যামিতিক হারে! দেয়ালে পিঠ ঠেকলে পলানো যায় না। তখন ঘুরে দাঁড়াতে হয়। হলোও তাই। সারা দেশের খুশি হওয়া জনতা বেরিয়ে এলো। কাতরভাবে ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা যে যেমন পারি, যতোটা পারি মানবো। কেউ না মানলেও সেটা তার ব্যাপার হবে। ধর্মকারী যেমন প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচার, প্রসার করতে পারবে, বিপরীতরাও সেটাই পারবে। এই কাজে কোনো অপরাধ হলে তা দেশের বিধিতে বিচার হবে; আমরা আইন আর হাতে তুলবো না। আমাদের রক্ষা করুন, বাঁচান; এমন লিখিত দিলো।
ক্ষমতায় বসা দল ইচ্ছেকরে আরেকটু দেরি করে। খুশির জনতা রাগের বদলে আরও কাতর হয়। তারপর জনতার কথা মেনে নেয় সরকার। এর প্রেক্ষিতে একদিন প্রথম দলের প্রধানকে নিয়ে আলোচনায় বসে দ্বিতীয় দল। মাঠ ভরা জনতা। সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, জিত তো প্রথম দলেরই হলো। তারা যা বলেছিলো সেটাই করলেন আপনারা। এ বিষয়ে কি অপমান/লজ্জা বোধ করছেন?
প্রথম দলের প্রধান দ্বিতীয় দলকে থামিয়ে বলেন, উত্তর আমি দিচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা নিজেদের আইন জনতার উপর চাপাতে চেয়েছিলাম। ওরা জনতার চাওয়াটা প্রয়োগ করেছে। বস্তুত ওরাই বাস্তবে বুঝিয়েছে যে, প্রথম দল সঠিক বলেছিলো! এজন্য আমরা লজ্জিত। জনগণকে বোঝার দিক থেকে দ্বিতীয় দল আমাদের চাইতে অনেক ঊর্ধ্বে। জনগণ যা চায় সেটাই আইন করতে না চেয়ে ভুল করেছি আমরা।
পরে সে দেশ হয় স্বর্গময়। নইটে গাছটি মুড়োলো, আমার গল্পও ফুরোলো!
একগাল হেসে বলি, 'মাছের তেলে মাছ ভাজা' মানুষে কেন প্রয়োগ করে বুঝেছি, দাদু। আমার দেশেও ধর্ম কটুক্তি ও অবমাননার আইনের প্রকৃত প্রয়োগ চাইছি। তাতে নিজেও জুতোর মালা পরে ফাঁসিতে চড়বো; দুঃখ থাকবে না। জুতোর অভাবও হবে না।

0 Comments