মনুষ্যত্ব (৬)

 মনুষ্যত্ব (৬)

- কাকলি চক্রবর্তী 



মুখ খুললেন অনুভা।বললেন,

"সবাই আমায় খুব নিষ্ঠুর ভেবেছিলো।

হ্যাঁ,খানিকটা তাই বটে।

সবার ওপরে আমার ঠাকুর, এটাই তো জেনে এসেছি

এতগুলো দিন।

সেই কবে স্বামীকে হাড়িয়ে ছিলাম।

সমাজ, আত্বিয় পরিজন শিখিয়ে ছিল,

এক বিধবা মানুষের জীবন যাপন কেমন হওয়া উচিত।

বৈধব্য কী?

কত কঠিন সেই জীবন।

সন্তান, সংসার, আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়সিদের

সামলে ছি একা হাতে।

তবুও জীবনের অনেক ওঠা পড়ায়,

অনেক কঠিন মুহূর্তে ডেকেও কাউকে কাছে পাইনি।

সব জন্ত্রণার, অবসাদের এক মাত্র ওষুধ আমার

ভগবান।

যার কাছে মনের সব কথা অকপটে শিকার করা যায়।

আলোচনা করা যায় সংসারের যাবতীয় কিছু।

সমাজ সংসার আমাকে খোলা ধরার মত

ধরিয়ে দিয়েছিলো ঈশ্বর কে।

মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল কিছু মূল্যবোধ,

সামাজিকতার কঠোর কঠিন নিয়ম।

যে কথাগুলো আমার মনে একেবারে গেঁথে বসেছিল।

সেই বোধ নিয়মের বেড়াজাল থেকে এই জন্মে আর

আমার বেরোবার কোনো উপায় নেই।

এভাবেই কঠোর কঠিন হতে হতে হয়তো

একটা পাষাণে পরিণত হয়েছিলাম।

একটা সময় মনে হলো সময় বদলাচ্ছে।

মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে,

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে

পিছিয়ে পড়তে হবে।

হেরে যেতে হবে।

কাছের মানুষ জনের সাথেও ক্রমশঃ

তৈরী হবে দূরত্ব।

আর কোথায় যেন নিজের সাথেই নিজের একটা

দূরত্ব তৈরী হচ্ছিলো।

নিজের কাছেই নিজেকে খুব ছোটো,

নিকৃষ্ট বলে মনে হচ্ছিলো।

ঈশ্বর সেবার নিরিখে,

ঈশ্বরের পথ থেকেই দূরে সরে যাচ্ছিলাম।

আর তাই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।

যে পাপ বোধ, অন্যাই আমার মনে চেপে বসেছিল,

তার ভার কিছুটা কম করার জন্যই,

ছুটে গিয়েছিলাম জবার গ্রামে।

স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে,

বিয়ের মন্ডব থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলাম জবাকে।

জবার বাবা মা কে বোঝালাম,

তারা মেয়ের কী সর্বনাশ করতে চলেছিলেন।

আমি ওদের কথা দিয়ে এসেছি,

জবা আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে

আমাদের সন্তানের মতোই থাকবে এই বাড়িতে।

লেখাপড়া করবে,

রিভার বোন হয়ে বাঁচবে।

নিজের পায়ে দাঁড়াবে। "


একটানা অনেক্ষন কথাবলে চুপ করলেন অনুভা।

ঘরে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।

এর পর আর কার কী বা বলার থাকে।

বাড়িতে এখন শুধুই আনন্দ।

যে অদৃশ্য কাঁটা তার টি ছিল সরে গেছে।

অনুভার কান্ডকারখানায় সবাই যেমন তাজ্জব,

তেমনি খুশি।

বিশেষ করে রিভা।

জবার এই বাড়ির সর্বত্র প্রবেশধিকার।

অনুভার সব দায় দায়িত্ব তার ওপরেই।

ঠাকুর ঘরের যাবতীয় পুজোর জোগাড় যন্ত ও

করে সে নিজের হাতেই।

তাকে ছাড়া যে অনুভার একটি দিনও কাটে না।

অনুভার বিশ্বাস তার ঠাকুর সব ঠিক করে দিয়েছেন।

গরমিল যা কিছু মিলিয়ে দিয়েছেন।

বিচ্ছিন্ন অবিচ্ছিন্ন সব গুছিয়ে দিয়েছেন।


ছিঁড়ে পড়া সুতো গুলো একে একে  বড়ো যত্নে জুড়ে,

একটা নকশি কাঁথার রূপ দিচ্ছেন অনুভা।

এমন এক নকশি কাঁথা,

যেখানে জাত পাত,

ধনী দরিদ্র, উচ্চ নীচ, বর্ণ বৈষম্য,

ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে,

যে ছবিটি পরে থাকে সেটা হলো

মানবতার ছবি।

মনুষত্বের ছবি,

মহামিলনের ছবি।।


সমাপ্ত।

Post a Comment

0 Comments