চরৈবেতি : পৃথিবীর উপহার - বৃষ্টি ও এক পথিক
- Bristy La wayfarer
--------------------------------------
।। দ্বিতীয় পর্ব ।।
ও ওর বোধকে নিয়ে গাঠনিক অস্তিত্বে ফিরে এলো ।
এটা সেই গাঠনিক জীবনের সাথে মনন মিলনের সন্ধিক্ষণ । সেই গাঠনিক জীবনে যেন আত্মসত্ত্বার অস্তিত্বের খোঁজ। ও অনুসন্ধানরত ।
আর ঘটে গেলো সেটা । যেন এটা হওয়ার ই ছিলো !
মস্তিষ্কে সকল সৃষ্টিশীল শক্তিগুলোর আকস্মিক বিস্ফোরণ । অন্তর্নিহিত শক্তিদের মুক্ত বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে চাওয়ার আস্ফালন । সমস্ত আলোতে যেন রঙের তীব্র বিচ্ছুরণ !
সহস্র বছরের ঘুমের জাগরণ । প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে ঘুমন্ত মানবযন্ত্রদের জাগানোর প্রচেষ্টা ওর । ও সকলকে বলে দিতে চাইলো ও কি "উপলব্ধি " করেছে ।
কিন্তু সেই ক্ষণিক কালে ও নিজের কাছে স্পষ্ট হতে পারছিল না। "সমস্তটা বুঝে ওঠার দায়" এর যে নিগূঢ় অনুভূতি তা এক বিমূর্ত আলোয় জ্বলে উঠলো ওর মাঝে । ওর অন্দরে ঘটে চলা বিষয়গুলো ও ব্যক্ত করতে পারছিল না কোথাও । ও এক নিবিড় একাকিত্বে ডুবে যেতে লাগল এই মুখোশাবৃত সাধারণদের মাঝে।
এ কেমন এক তিক্ততা, অজানা অস্বস্তি ! কখনো চলমান বিষন্নতা, কখনো অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, কখনো বা ক্লান্ত চোখে ভীষণ একঘেয়েমি।
এ সময়টা ছিলো ওর মস্তিষ্কের সুস্থিত গঠনের । মহাজাগতিক চেতনার ছাঁচে নিজেকে সাজানোর ।
দুসঃহ সেই সময় ! বিদ্রোহ থেকে বিপ্লব পর্যন্ত !
একটা মিষ্টি পুণর্নবীকরণের অনুরণন হলো । ওর চেতনা সেই পথ তৈরির যেখানে সৃষ্টিশীলতার মেলা বসবে, পরম জ্ঞানের সুর ও তালে ঘটবে পরম আনন্দের প্রাপ্তি । ক্ষুদ্রকায় চেতনা গুলো সমাধিস্থ হচ্ছিল সেই গলিত জ্বলন্ত পরম জ্ঞানের রূপে।
মহাবিশ্বের নিরবতা বারবার ওকে ডাকতে লাগলো যেন কিছু বলার আছে । বৈশ্বিক উদাসীনতা এক আবছা সুরক্ষা গড়ে তুললো ওর সেই "পথে"!
ও চলছে। এ পথ ওর কাছে এখন আরো বেশি আকর্ষণীয় । বিমোহিত, মুগ্ধ ও ! ক্ষণিক উদাসীনতার মাঝেও ও অনুভব করতে পারলো এই পথের কম্পমান গতিশীলতা।
এগিয়ে চলো ! স্রোতহারা হওয়ার কড়া নিষেধাজ্ঞা । এবারে এগিয়ে চলো !
সকল সময়ের সমন্বিত কন্ঠের আবদার এটি । রোদ-মেঘ-বৃষ্টিতে। আলো ও অন্ধকারে । এগিয়ে চলো !
ও নিজেকে খুঁজে পেলো নিরন্তর চলমান।
ও পথিক ! ও সভ্যতার আগুন্তক !
এক অনন্য অনুভূতি ওর সমস্তকে বিদ্যুতায়িত করলো ।
ওর বোধ এই অনুভূতির বিশ্লেষণ করতে লাগল, এরপর সংশ্লেষণ ।
ও তখনো অবিরাম চলমান।
ও চলছিল, পথের প্রতিটি কোণের অনুধাবন নিয়ে । শহরের ঝলমলে বাতিগুলো ক্ষীণ ভেসে উঠছে ওর চোখে । রঙিন আলোর সমাহার । শহরের রাস্তার দুপাশ বাগানে ঘেরা । রঙিন কিছু বাঁশের বেড়া ঘিরে রেখেছে একে। মাঝেমাঝে কিছু ফুল বেড়ার ফাঁকে মাথা গলিয়ে দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে পথচারীদের । এখানে সকলেই আছে । শিশু, ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ, কিছু লোক । সব মিলিয়ে এই শহর ।
ও বসার জন্য একটা শান্ত জায়গা খুঁজতে লাগল । যেখানে নিজেকে নিয়ে বসে নিজের সাথে গল্প জুড়ে দেয়া যায় । আশেপাশে ক্ষুদ্র জীব সব-তাদের কলকাকলি, যুবক-যুবতীদের জুটি, অচেনা অনেক মুখ ।
কিঞ্চিৎ হাসির শব্দ পেলো পেছন থেকে, ও ফিরে তাকালো ।
-"এই,চিনতে পেরেছ আমাকে?"
-"হ্যাঁ, দেখেছি তোমাকে এর আগেও ", ও বললো।
-" বেশ তবে !"
ছেলেটি কথা বলা শুরু করলো । ঘরের ও বাইরের, কিংবা কর্মস্থলের শত ব্যস্ততার গল্প শোনাতে লাগলো । ওকে পাশে রেখেই প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সকল কিছুর সমাহার তুলে ধরলো ।
সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছিল । ওর মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো । এতশত গল্পের মাঝেও ও নিজেকে খুঁজে পেলো না কোথাও। রুদ্ধশ্বাস ওর । নিথর দেহ আর অপলক দৃষ্টি । ধমনী ও শিরায় রক্ত প্রবাহ যেন তার গতিবেগ হারিয়েছে । এক অস্তিত্বকর চাপা অনুভূতি ওকে কুঁড়ে খাচ্ছে । ও হারিয়ে যাওয়া সেই অন্তর্নিহিত সুরের খোঁজে আত্মহারা । এই তথাকথিত সুখ দুঃখের গল্প, সংসার আলাপে নিজেকে বড়ই বেমানান মনে হলো ওর । সবাই যেন এই ক্ষূদ্রতার কারাগারে বন্দী দশার সাচ্ছন্দ্যতায় ভাসমান । কিন্তু ওর তো চাই মুক্ত বাতাস, চিন্তার সীমারেখার উর্ধ্বে ।
হঠাৎ প্রকৃতির কোনো এক গল্পে নিজেকে আবিষ্কার করলো ও । "একটি কাক ভাঙা স্তম্ভের উপর বসে আপেল ঠুকরে খাচ্ছিলো । কিন্তু ঈগল সেই অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতায় নেই । সে আপন মনে তার উড়ানে মনোনিবেশ করলো ।"
ও ঈগলটির মাঝে নিজেকে খুঁজে পেলো, যে মিথ্যে ক্ষণিক সুখে নিজেকে আবদ্ধ করেনি, মুক্তি ই তার পরম প্রাপ্তি । ঈগলটির উড়ে যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ ।
মানুষরূপী অনেক গাঠনিক যন্ত্রের সাথে দেখা হলো ওর এ পথে । তারা এ শহরকে গড়ে তুলেছে এক রঙ্গ মঞ্চের মতো করে । ছোট ছোট নাটক এর প্রতিটি পরিচ্ছেদে লেখা । তবে এতসব গল্পের বিশেষ কোনো অর্থ নেই ওর কাছে । যাইহোক, ও জানে এ সাধারণতার উর্ধ্বে ওর অনেকটা করার আছে।
কিছু শহরবাসী তাদের দুঃসাহসিক জীবন গাঁথা শোনাচ্ছে ।
-" ভয়ানক ! অন্তহীন ! " কেউ একজন খুব বিস্মিত কন্ঠে বললো ।
-"না ! এর একটি শেষ তো আছে বটে । খুব কম সাধু, জ্ঞানীগুণী আছেন যারা এ পর্যন্ত পৌঁছেছেন ।"
একি সেই পথ !
ও চুপচাপ শুনছে, অচেনা পথিকের মতো । ওর দিকে তেমন খেয়াল নেই কারোর । তারা তাদের কথা বলে যাচ্ছে ।
ধীরে ধীরে তাদের সকল আলোচনা একগুচ্ছ একঘেয়েমিপূর্ন গুঞ্জনে পরিণত হলো । শত অপ্রয়োজনীয় তথ্য ও তার বিশ্লেষণ ।
না, এভাবে সময় নষ্ট করার কোনো অর্থ নেই । এক চিলতে অদেখা হাসি নিভৃতে ওর মুখ ছুঁয়ে গেলো । এ সকল আত্মভূষিত জ্ঞানীরা "এটি" কখনোই সরাসরি এভাবে অনুভব করতে পারেনি ।
ওর কিছুটা খারাপ লাগলো তাদের জন্য ।
তারা দেখেছে, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারেনি ।
এ শহর এক বহুতল বিশিষ্ট পিরামিডের মতো । এখানে শহুরে ও গ্রামবাসীদের এক রহস্যময় মেলবন্ধন রয়েছে। ও এসবের ভেদ বুঝতে চাইল নিজেকে এর মাঝে মিশিয়ে । ওর গাঠনিক সত্ত্বা এর বিচরণে বের হলো ।
এ শহরের আবর্জনাপূর্ণ জায়গাগুলোতে নিম্নবিত্তদের বসবাস । তাদের প্রায় সকলের জীবনই এ শহরের দাসত্বে নিয়োজিত ।
মাঝামাঝি পর্যায়ে বসবাস মধ্যবিত্তদের । এই শ্রেণী হলো সর্বাধিক আবদ্ধ ও রক্ষণশীল মনোভাবপূর্ণ । কিন্তু এর বৈপরীত্যে, সভ্যতার বেশিরভাগ আগুন্তক এই স্তর থেকেই আগত।
উচ্চবিত্তদের এলাকায় অবশ্য সাধারণদের প্রবেশ বেশ সীমাবদ্ধ । সাজানো গোছানো রসহীন বাড়িঘর তাদের । রোমাঞ্চহীন জীবন, একঘেয়েমি ও চাপা একাকিত্ব ।
এ শহরের গদ্যে বিচরণ শেষ হলো এবার ওর। ও আবারো আত্মসত্ত্বায় ফিরে এলো - ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে।

0 Comments